ছোট গল্প: রাঙা মামা

132

অমিতাভ নাগ

– ‘সুকু, খবর পেয়েছিস? রাঙা মামা  মারা গিয়েছে, এক্সিডেন্ট।’

– ‘সেকি রে ! কোথায়? কী ভাবে?’

– ‘আর বলিস না! তোর সময় হবে আজ? একবার আসতে পারবি? কথা আছে রে, ইম্পরট্যান্ট।’

প্রবাল ফোনটা রেখে দেয়। মনটা খারাপ হয়ে যায় সুকুর। রাঙা মামাকে ওরা সবাই ভালোবাসতো – এককালে খুবই। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনিই আলগা হয়ে যায় গ্রন্থি, সেভাবেই রাঙা মামা স্মৃতির ভিতর থেকে গিয়েছিলেন। বয়স কত হবে? সুকু ভাবার চেষ্টা করে । ওরা যখন ৮-১০ তখন পাড়ার সনাতন কাকার বিয়ে হল সুন্দরী কাকিমার সঙ্গে। কাকিমার নাম ছিল নীলিমা, সুকু মা-র কাছে নামটা শুনেছিল । কিন্তু ওরা সেই নামে কোনোদিন ডাকেনি। প্রবালই চিরকাল ওদের মধ্যে চৌকস, বুদ্ধিমান। ‘সনাতন কাকা অমন জাম্বুবানের মতো দেখতে, আর কাকিমা কি সুন্দরী মাইরি’  বলেছিল প্রবাল। সেই থেকে নীলিমা কাকিমা হয়ে গেলেন সুন্দরী কাকিমা । এক সিকি শতাব্দী আগের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুকুর। সনাতন কাকার বিয়েতে খুব মজা হয়েছিল । বাড়িতে ভিয়েন বসিয়েছিলেন হাসি-দিদা, সনাতন কাকার মা। লাড্ডু, ল্যাংচা, রসগোল্লা কত যে পাড়ার ছেলেরা খেয়েছিল! বিয়েতেই রাঙা মামার সঙ্গে আলাপ, ওদের সঙ্গে রসগোল্লা খাওয়ার লড়াইয়ে। সুন্দরী কাকিমার দাদা, আপন।

সেই থেকে মাঝে মাঝেই রাঙা মামা চলে আসতো ওদের মফস্বল শহরে। একটা এনফিল্ড বুলেট মোটরসাইকেল ছিল কালো রঙের। তাতে করে টোটো ঘুরত পুরো শহর। নানা রকমের লজেন্স, হজমি সব সময়ই ষ্টকে থাকত রাঙা মামার। লম্বা ঢোলা জিনসের জামা, জিনসের প্যান্ট, নীল টুপি, পায়ে স্নিকার, চোখে কালো চশমা আর কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ – এই ছিল রাঙা মামার ছবি । তাদের সেই শান্ত, সমাহিত শহরে রাঙা মামার আবির্ভাব বেশ নাটকীয় ছিল । ভটভট করে ধোঁয়া উড়িয়ে রাঙা মামাকে দেখতে  সুকু-প্রবালের খুব ভালো লাগতো – এমনই হিরো হিরো ব্যাপার ছিল রাঙা মামার মধ্যে। ফর্সা চেহারা, রোদে ঘুরে তামাটে – মাঝেসাঝে আস্তিনের তলা দিয়ে রাঙা মামার গায়ের আসল রং উঁকি দিত। ‘তুমি কি সুন্দর দেখতে গো রাঙা মামা’ সুকু একবার বলে ফেলেছিল। রাঙা মামা অদ্ভুত ভাবে হেসেছিল, মজা নদীর ধারের কাশফুলের মাঝে শুয়েছিল সুকু আর প্রবাল, তারা তখন ক্লাস এইট। ‘চেহারাটা বড়ো কথা নয় রে, মনটা আসল’ রাঙা মামা বলতে বলতে চশমাটা খুলেছিল। সুকু অবাক হয়ে দেখেছিল এতো সুন্দর চোখ ও কারো হয়! অথচ কোন আভরণ নেই, স্বচ্ছ দীঘির মত যেন। ‘তোমার বিয়েতে আর কেউ আসেনি কেন গো কাকিমা?’ প্রবাল সুন্দরী কাকিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। ‘কে আসবে রে? কেউই তো নেই। বাবা তো আগেই মারা গিয়েছিলেন, দিদি ছিল একটা, সে ও। আর ওই দাদা’, সুন্দরী কাকিমা বলেছিল – ‘পাড়া প্রতিবেশীও কেউ জানা নেই বেশি আমরা তো নতুন এসেছিলাম, আর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই ।’ পাড়ায় সনাতন কাকাদের অনেকেই দেখতে পারতো না, এতো বড়োলোক ছিল । তায় সুন্দরী কাকিমার অমন রূপ, বিয়ের পর থেকেই নানা কথা চলত। প্রবালের মা একদিন বাড়িতে তাঁর জা-কে বলেছিলেন ‘ওতো সুন্দরী তো কি? ফ্যামিলিতে সমস্যা আছে কিছু নির্ঘাত নাহলে সনাতনের সঙ্গে বিয়ে দেয়? ওর ডবল বয়স তো বোধহয় ।’ এমন কথা তারা বড়োদের থেকে অনেকসময়ই শুনতো। ‘খালি নিন্দা, সুন্দরী কাকিমাকে কেউ দেখতে পারে না কেন রে?’ সুকু একবার প্রবালকে জিজ্ঞেস করেছিল। ‘ছাড় তো ওদের, কোনো ভালো জিনিস দেখেছিস এদের ভালো বলতে? বাবা-মা মাইরি আছে শুধু কাঠি করতেই’ বিজ্ঞের মতো বলেছিল প্রবাল।

রাঙা মামা এনফিল্ডে চাপিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেত কত সময়। কালী পুজোয় তুবড়ি বানিয়ে দিত অনেক কটা । সুকু বরাবরের সরল ছিল -‘তুমি বিয়ে করবে না, মামা?’ ‘দূর, কে করবে আমাকে?’ বলেছিল রাঙা মামা চুরুট ধরাতে ধরাতে। ‘কেন, করবে না কেন? তুমি তো খুব ভালো’ সুকু বলেছিল। হা হা করে হেসে উঠেছিল রাঙা মামা। ‘না রে, চাল-চুলো নেই । চাকরি-বাকরি করি না, ঘুরে বেড়াই খালি।’ প্রবাল ভাবুক হয়ে যায় -‘পড়াশোনা করোনি ঠিক করে ছোটবেলায়, না?’ ‘তাতো করিই নি । বাবা এতো মারতো। কতবার পালিয়ে গেসলাম বাড়ি থেকে ।’ রাঙা মামা এরকমই উদাস হয়ে যেত । পড়াশোনায় সুকু ও ভালো ছিল না। দুবারের বার ফেল করতে বাবা এমন মেরেছিল সুকু ঠিক করেছিল পালিয়ে যাবেই। কতবার রাঙা মামাকে পটাবার চেষ্টা করেছে পালাতে সাহায্য করতে, উল্টে সে সুন্দরী কাকিমাকে বলে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিল। কী মার খেয়েছিল সেবার জানাজানি হওয়ায় । ‘তুই একটা গবেট’, বলেছিল প্রবাল ‘এসব গুরুজনদের বলতে আছে? শালা কেটে পড়বি একা, তা না খালি ধানাই পানাই ।’ সুকুর অবস্থা তখন এমনিতেই সঙ্গীন – ‘সত্যি রে বিশ্বাস কর রাঙা মামা এমন বলে দেবে ভাবি নি রে।’ প্রবাল মাথা নাড়ে – ‘আর রাঙা মামাকেও পাড়ার বড়োরা আচ্ছা করে দিয়েছে। বাবার কাছে শুনলাম সবাই নাকি সনাতন কাকাকেও নালিশ করেছে এই বলে যে রাঙা মামা ছেলেধরা ।’ ‘কী বলছিস রে? এতো কান্ড? রাঙা মামা ছেলেধরা? এদের কি মাথা খারাপ? আর আমরা কি ছোট নাকি?’ সুকু নিজের দুঃখটা কিছুক্ষণের জন্য যেন ভুলে যায়। তারপর থেকে রাঙা মামা সত্যিই শহরে আসা কমিয়ে দেয়। ‘দাদা খুব দুঃখ পেয়েছে রে। তোর কাকাকে সবাই বলতে এসেছিল তো, তাতেই। আমিই বলেছি ঘনঘন আসতে হবে না । আসলে একা থাকে তো, তাই বার বার ছুটে ছুটে আসে।’ সুন্দরী কাকিমা হাসি মুখেই বলেছিল। মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর প্রবালকে একটা পেন দিয়েছিল মামা, প্রবাল জেলার মধ্যে স্ট্যান্ড করেছিল। সুকু কোনোরকমে সেকেন্ড ডিভিশন। রাঙা মামা কিসের একটা ফর্ম দিয়ে গিয়েছিল এখন আর সুকুর মনে পড়ে না।

– ‘আরে জর্জ টেলিগ্রাফের কিসব কোর্স ছিল তার ফর্ম দিয়ে গেসল রাঙা মামা, আমার মনে আছে। আমায় পেন দিয়ে তোকে ফর্ম – তুই রেগে ফর্মটা ছিঁড়ে দিয়েছিলি মনে আছে’ প্রবালের ক্লিনিকে বসে আছে সুকু।  দক্ষিণ কলকাতায় থাকে এখন প্রবাল, নামজাদা ডাক্তার। সুকুও এদিকেই, একটা মাঝারি ব্যবসা। পুরোনো দিনের দিকে সস্নেহ দৃষ্টি ছাড়া ফিরে দেখার ইচ্ছে বা সময় দুজনের কারোই নেই। তবে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, আড্ডা-মদ্যপান নিয়মিতই।

– ‘যাগ্গে বল কেন ডাকলি? আজ তোর ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই মনটা খুব বিষন্ন রে। রাঙা মামার কথা খুব মনে পড়ছে। মাধ্যমিকের পর আর সেভাবে দেখা হলো না। সনাতন কাকা মারা যাওয়ার পর এসেছিল। আমায় জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল। চেহারাটাও ভেঙে গেসল, কেমন লম্বা চুল রেখেছিল পরে। আমায় তো মাঝেমধ্যে বাড়ি যেতে হয় মা-কে দেখতে, পরে ও বার কতক দেখা হয়েছে। ভালো লাগেনি রে। কেমন যেন গায়ে পড়া ভাব।’ এক নিঃশ্বাসে বলে সুকু।

– ‘হুম । আমার সঙ্গে তো আর পরে দেখা হয়নি সেভাবে। এইচ এসের সময় কলকাতায় এলাম তারপর তো সেই ছুটিতে যেতাম তখন আর দেখা হতো না। পরে একবার হার্টের ডাক্তারের জন্য ফোন করেছিল। বলেছিলাম কলকাতায় এস আমি তোমার সব ব্যবস্থা করে দেব। রাজি হলো না মাইরি।  আজ বুঝলাম কেন আমার হেল্প নেয়নি।’ প্রবাল গম্ভীর হয়ে যায়।

– ‘ মানে? কি বলছিস? খোলসা কর আরও,’ সুকু অধৈর্য হয় ‘তার আগে বল তোকে খবরটা দিল কে? তোর সঙ্গে ওদিকের কারো যোগাযোগ আছে বলে তো শুনিনি।’

– ‘দাঁড়া ওতো হুড়ো দিস না। আমাদের ব্যাচের দীপককে মনে আছে? রেল কলোনিতে থাকত। ওরা যদিও অনেক পরে এসেছিল আর বেশিদিন থাকেনি তখন। ও পরে আমার সঙ্গে মেডিক্যাল পড়ল। তখন বেশ ভাব হয়ে গেসল বুঝলি। ও এখন সদর হাসপাতালে আছে। কলকাতায় ছিল কিছুদিন এখন যেচেই ওখানে গেছে – আদর্শের সুড়সুড়ি বুঝলি তো ‘ প্রবাল চোখ ছোট করে।

– ‘ ধুর। ওখানে পড়ে থেকে কী হবে? মা আছে তাই যাই, নাহলে আর …’ সুকু একটু থেমে যায় ‘সুন্দরী কাকিমার চেহারাটাও ভেঙে গিয়েছে জানিস। কেমন কালো কালো লাগে। রাঙা মামার মতো অনেকটা যেন। কিন্তু দীপকের কথা কেন?’

– ‘দীপক আমায় ফোন করেছিল কাল রাতে। আমায় যা বলল তাতে উত্তেজনায় ঘুমোতে পারিনি গুরু । ভেবেছিলাম আমি একবার যাবো কিন্তু এই উইকটা খুব চাপ। তোকে ডাকলাম কারণ ভাবলাম তোকে বলা যায়, তুই একবার সুন্দরী কাকিমার সঙ্গে পারলে গিয়ে কথা বললে হয়তো বেটার।’  প্রবাল তাকায় সুকুর দিকে।

– ‘আমিও শুনে থেকেই ভাবছি একবার যাবো। সেই তো কিছুদিন পর যেতামই। এক্সিডেন্ট কীভাবে হলো রে?’

– ‘হ্যাঁ একবার গেলে ভালো। সেকারণেই ডাকলাম। সামনাসামনি কথা বলা দরকার। ফোনে হতো না। ‘ গেলাসটা ঠোঁটের কাছে তুলে  আবার নামিয়ে রাখে প্রবাল, ‘এক্সিডেন্ট নয় রে ঠিক’ জলে এবার চুমুক দেয় সে।

– ‘কিছু হেঁয়ালি মাইরি, ফোনে বললি এক্সিডেন্ট এখন বলছিস না’ সুকু বিরক্তই হয়।

হুহু করে গাড়িটা ছুটছে, ন্যাশনাল হাইওয়ে তাই ইনোভায় স্পিডও উঠছে হুহু করে। ভোর ভোর বেরিয়েছে সুকু।  রাতের ভিতর কলকাতায় ব্যাক করতে হবে। আগামী কাল কর্পোরেশনে কিছু কাজ আছে সেটা মিস করা যাবে না। গতকাল প্রবালের কথা গুলো নাড়িয়ে দিয়েছে ওকে। শহরে ঢুকতে ঢুকতেই ১০:৩০ বেজে গেল। বাড়িতে না গিয়ে প্রথমে সুন্দরী কাকিমার বাড়ি ঘুরে যাবে এমনটাই ঠিক করল সুকু।  বাড়িটা বিশাল। তবে এখন ভগ্নদশা। কাকিমা আর কয়েকজন পুরোনো কাজের লোক থাকে ওত্তোবড়ো বাড়িটায়।

-‘আয় রে সুকু, দাদার খবর পেয়েছিস তো?  কে বলল তোকে, সুরমাদি?’ কাকিমা এখনো সেই আগের মতো প্রণাম করলে থুতনি ধরে চুমু খায়।

– ‘না গো কাকিমা, প্রবাল জানালো কাল, ওর এক বন্ধু ডাক্তার সদর হাসপাতালের। উনিই বলেছেন …’

– ‘সুকু’ কাকিমা চিৎকারের মতো করে উঠেই থমকে যান। সুকুও চিরকালের নিরীহ কাকিমার হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক  হয়ে যায় কিছুটা। কাকিমাও একটু হাঁপ নেন ‘দাদার মৃত্যুটা রোড এক্সিডেন্ট। তুই জানিস বোধহয়। এপাড়ার সবাই  সেটাই জানে।  তোরা কলকাতায় থাকিস, কত নামডাক তোদের এখন। এলে আমাদের সঙ্গে দেখাশোনা করে যাস খুব ভালো লাগে রে।  কিন্তু আমাদের তো বাকি জীবনটা এখানেই কাটাতে হবে! দাদা তোকে খুব ভালোবাসতো। তুই নিশ্চয়ই বুঝবি।’

– ‘কাকিমা, চিন্তা কোরো না। সবাই রোড এক্সিডেন্টের খবরটাই জানবে’ সুকু পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে চায় ‘কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল গো?’

– ‘পেটে একটা টিউমার ছিল, সেটার চিকিৎসাও করাচ্ছিল । এখানের ডাক্তার বলেছিল ক্যান্সার, অপারেশন করতে হবে। দাদা কলকাতা ও গিয়েছিল, প্রবালকেও ফোন করেছিল তো । অপারেশনটা করালে হয়তো বেঁচে যেত। আমি বলেওছিলাম, কলকাতা কত বড় জায়গা কেউ জানাশোনাও নেই। দাদার জেদ তো আমি জানি। শুনলই না সে কথা। কে এক হাতুড়ে ডাক্তারের কী ওষুধ খেলো শেষে বার্স্ট করেই …’ কাকিমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে কিছুটা কেঁদে নিল । সুকুর অস্বস্তি বাড়তে থাকে । শোকের বাড়ির পরিবেশ সুকুর কোনোদিন ভালো লাগে না ।  কাকিমা স্বাভাবিকভাবেই এখনো রাঙা মামার মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না ।

– ‘আচ্ছা, ছোটবেলায় এর জন্য রাঙা মামা বকুনি খায়নি ? মানে আমাদের সব এদিকে …’ কিছুটা যেন প্রসঙ্গ পাল্টাতেই সুকু জিজ্ঞেস করল ।

– ‘হ্যাঁ তো, কম মার্ খেয়েছে বাবার কাছে? একবার তো এমন মারল যে হাত ভেঙে গেল । আমার থেকে তো বড় ছিল কিছুটা । আমার ওপরের দিদিটা ও খুব ভালোবাসত দাদাকে । ও মরে যাওয়ার পর বাবা ও কেমন হয়ে গেল । দাদাও চলে গেল । কত খোঁজ করেছিলাম রে, কেউ খোঁজ দেয়নি । আমরাও আসানসোলে চলে এলাম সব ছেড়েছুড়ে । বছর পাঁচেক পর বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা এসেছিল ।’ কাকিমা সামলে নিয়েছে অনেকটা ।

– ‘তখন থেকেই কি এরকম উড়নচন্ডী ছিল? কিন্তু কি সুন্দর দেখতে ছিল রাঙা মামাকে , না?’ সুকু যেন পিছনে ফিরতে চায় ।

– ‘একদম আমার মতো দেখতে ছিল । বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে কোথায় ছিল সেটা দাদা কোনোদিন বলেনি । তবে তখনই বোধহয় এইরকম সব পোশাকআশাক । তবে খুব চুরুট খেত, বলেছিল চুরুট খেলে নাকি গলার আওয়াজ পাল্টে যায়, কে জানে ।’

– ‘তুমি কোনোদিন কিছু বলোনি?’

– ‘নাঃ । যার যার নিজের জীবন । আমার বাবা গরিব মাস্টার ছিল । তোদের রাঙা মামা তাও এই যাঁতাকল থেকে বেরোতে পেরেছিল যেভাবেই হোক । তবে প্রথম প্রথম একটু মানাতে তো অসুবিধা হতোই । সম্বোধনের ও বিপত্তি ছিল । বিয়ের পর তো খুব আসতো তারপর সেই গন্ডগোলের পর আমিই বারণ করেছিলাম ।’

= ‘হ্যাঁ, জানি তো সেসব কথা । আমাদের পাড়ার বড়োদের অদ্ভুতামোর কোনো সীমা নেই । সত্যি কি খারাপ যে লেগেছিল । আমাদের এতো ভালোবাসত । বাবা তো খুব প্যাদাতো আমায় । রাঙা মামাই আদর করতো ।’

– ‘ঠিক, তোকে ভালোবাসত খুব । এখন এতদিন পর হয়তো বলতে অসুবিধা নেই, একটু বেশিই হয়তো । আমার খুব স্বাভাবিক লাগতো না, তাই দাদাকে বলেছিলাম বেশি না আসতে ।’ কাকিমা বিষন্ন ভাবে তাকায় সুকুর দিকে ।

– ‘কী বলছ তুমি কাকিমা?’ সুকু চেঁচিয়ে ওঠে ।

– ‘সত্যি, একটা বিশ্রী কান্ড হওয়ার আগেই থামাতে হতো রে’ কাকিমা সুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ‘মন খারাপ করিস না রে, যা হয়েছে সেসব ভালো হয়েছে । তবে মরার বয়স তো হয়নি সেটা ভেবেই খারাপ লাগে ।’

– ‘আচ্ছা, সনাতন কাকা জানতো রাঙা মামার ব্যাপার সব, তুমি বলেছিলে?’

– ‘দাদা যে তোর প্রতি কেমন অস্বাভাবিক দুর্বল সেটা বলেছিলাম যখন পাড়ার লোক ওনার কাছে এসে বললো যে দাদা ছেলেধরা । উনিও দাদাকে সাবধান করে দিলেন তো ।’

– ‘আর আগের কথা?’

– ‘মাথা খারাপ নাকি? দাদা যে কথা কাউকে বলতে চায়নি, এমনকি ডাক্তারের কাছে যেতেও ইতস্তত করেছে সেটা বলে ওকে অপমান করব কেন?’

– ‘তাহলে আমায় এতো কথা বললে কেন কাকিমা?’ সুকু বিভ্রান্ত হতে থাকে ।

– ‘কারণ তুই তো এখন সব জানিস । আর তো গোপন কিছু নেই । তবে তুই আর কাউকে জানাস না রে তাহলে আমার খুব কষ্ট হবে ।’

– ‘উঠি আজ কাকিমা । বাড়ি গিয়ে মা-র সঙ্গে দেখা করে বিকেলে বেরিয়ে যাবো ।তুমি ভালো থেকো ।’ সুকু উঠে পড়ে ।

– ‘দাঁড়া রে, একটা জিনিস তোকে দেওয়ার জন্য আমায় দিয়েছিল, ভুলে গেসলাম । মনে থাকে না তো কিছু ‘ কাকিমা ভেতরের ঘর থেকে একটা ধুলো পড়া বাক্স নিয়ে আসে । সুকু দেখে ভেতরে একটা মাউথ অর্গান । ‘তোর রেজাল্টের ওপর অনেক আশা করেছিল । ফার্স্ট ডিভিশন পেলে দেবে বলেছিল । তুই তো আর পেলি না । পরে তুই ব্যবসা ভালো করেছিস খবর পেয়ে এটা দিয়েছিল আমায় তোকে দেওয়ার জন্য । মনেই ছিল না ।’

– ‘এটা আমি নিতে পারব না কাকিমা ।’ সুকুর হঠাৎ খুব অভিমান হয় রাঙা মামার ওপর । এতো ভালোবাসা কোনোদিন বলেনি কেন ওকে, আলাদা করে বুঝতেই দেয়নি । বাড়ি থেকে পালতে বারণ করতো কি তাহলে এই কারণে যে নিজেই একদিন পালিয়ে যাবে ওকে নিয়ে? তোলপাড় হয়ে যেতে থাকে সুকু ।

– ‘নিয়েই যা সুকু । কোনদিন শুনবি কাকিমা মরে গেছে তখন আর এটা পাবি না । তুই তো বাজাতিস আগে । রেখে দে দাদার স্মৃতি হিসেবে’ |

হ্যালো প্রবাল, সুকু বলছি রে । শুনতে পাচ্ছিস? ফিরছি এখন । দীপক ঠিকই বলেছে রে । ওভারি বার্স্ট করেই হয়েছে । ক্যান্সার হয়েছিল রে । কাকিমার বললো ।’

– ‘হ্যাঁ, সেরকমই সাস্পেক্ট করেছিলাম । আচ্ছা আমরা কোনোদিন বুঝতে পারিনি কেন রে?’

– ‘সেই, শুধু আমি না তুই ও কেমন ল্যাদোশ ছিলি দ্যাখ । এখন কেমন লজ্জাই করছে, না?’

– ‘না রে আমার সেকারণে করছে না, রাঙা মামা যে মেয়ে সেটা কোনোদিন ধরতে দিল না মাইরি । কি দারুণ ফুটবল খেলত না রে ? আমরা সত্যি ওর দিকে সেভাবে কখনো দেখিনি । বাবা কাকারা বোধহয় জানতো তাই ওই বয়সে কাটিয়ে দিল ।’

– ‘ঠিক বলেছিস । মা-কে জিজ্ঞেস করলাম রে আজ । মা কিছু বললো না যদিও ।’

– ‘ছেড়ে দে, কিছু কি আর আসে যায় এতে? তবে রাঙা মামা বলব নাকি পিসি?’ প্রবাল হাসতে থাকে টেলিফোনের ওপারে ।

– ‘না রে প্রবাল । এতটা ইনসেন্সিটিভ আমরা বোধহয় না হলেও পারি । ওহ শোন রাঙা মামা আমার জন্য একটা গিফট রেখে গেসলো তোর পেনের সঙ্গে ।’ বলতে বলতে সুকু খেয়াল করে মাউথ অর্গান ফেলে এসেছে মায়ের কাছে । মা-কে দেখানোর পর গাড়িতে ওঠার সময় তালেগোলে ভুলে গিয়েছে সুকু – রাঙা মামার দেওয়া একমাত্র উপহার ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

13 − six =